এশিয়ার নদী বিতর্ক: সংকট, সংঘাত ও সমাধানের পথরেখা
এশিয়ায় নদীকেন্দ্রিক সমস্যার মূলে রয়েছে তিনটি বিষয়: পানির হিস্যা (Water Sharing), বাঁধ নির্মাণ (Dam Construction) এবং পরিবেশগত বিপর্যয়। নিচে অঞ্চলভেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
১. দক্ষিণ এশিয়া (ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও নেপাল)
এই অঞ্চলে নদীকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে বেশি কূটনৈতিক উত্তেজনা বিরাজ করে।
-
গঙ্গা নদী (ভারত ও বাংলাদেশ):
-
সমস্যা: ফারাক্কা বাঁধের কারণে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে পানির প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়া। আবার বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেওয়ায় আকস্মিক বন্যা সৃষ্টি।
-
দেশ: ভারত ও বাংলাদেশ।
-
-
তিস্তা নদী (ভারত ও বাংলাদেশ):
-
সমস্যা: তিস্তার পানির সুষম বণ্টন নিয়ে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত চুক্তি। সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গে গজলডোবা বাঁধের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করায় উত্তরবঙ্গ মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে।
-
দেশ: ভারত ও বাংলাদেশ।
-
-
সিন্ধু নদী (ভারত ও পাকিস্তান):
-
সমস্যা: ১৯৬০ সালের ‘সিন্ধু পানি চুক্তি’ থাকলেও কিষাণগঙ্গা ও রাটল জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে দুই দেশের মধ্যে তীব্র বিরোধ রয়েছে। পাকিস্তান মনে করে ভারত উজানে বাঁধ দিয়ে তাদের কৃষি ধ্বংস করছে।
-
দেশ: ভারত ও পাকিস্তান।
-
-
ব্রহ্মপুত্র নদী (চীন, ভারত ও বাংলাদেশ):
-
সমস্যা: চীন তিব্বতের উজানে বিশাল বাঁধ নির্মাণ করছে। ভারত ও বাংলাদেশ শঙ্কিত যে, চীন পানির গতিপথ পরিবর্তন করলে এই অঞ্চলের বাস্তুসংস্থান ধ্বংস হয়ে যাবে।
-
দেশ: চীন, ভারত ও বাংলাদেশ।
-
সমাধান : সমাধান হিসেবে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ নদী কমিশন প্রতিষ্ঠা হয়েছে। কিন্তু এর কার্যকারিতা অনেকাংশে কম।
২. দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া (মেকং অববাহিকা)
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জন্য মেকং নদী হলো জীবনরেখা।
-
মেকং নদী:
-
সমস্যা: চীন মেকং নদীর উজানে (ল্যানকাং নদী অংশে) একের পর এক ১১টি বড় বাঁধ নির্মাণ করেছে। এতে নিচের দিকের দেশগুলোতে (লাওস, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম) পানির স্তর কমে গেছে, লোনা পানির অনুপ্রবেশ বাড়ছে এবং মৎস্য উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
-
দেশ: চীন, লাওস, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও মিয়ানমার।
-
সমাধান: মেকং রিভার কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে বিরোথ কমে এসেছে।
৩. মধ্য এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য
-
ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস: তুরস্ক উজানে আনাতোলিয়া প্রজেক্টের অধীনে বাঁধ দেওয়ায় ইরাক ও সিরিয়া পানির অভাবে ধুঁকছে।
-
দেশ: তুরস্ক, সিরিয়া ও ইরাক।
প্রধান সমস্যাগুলো কী কী?
১. উজানের খবরদারি: উজানের দেশগুলো (যেমন চীন বা ভারত) বাঁধ দিয়ে পানি নিয়ন্ত্রণ করে, যা ভাটির দেশের কৃষি ও জীবনযাত্রায় বিপর্যয় আনে।
২. পলি জমাকরণ: বাঁধের কারণে পলি আটকা পড়ে নদীর নাব্যতা কমে যাচ্ছে।
৩. নোনা পানির অনুপ্রবেশ: নদীতে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমলে সমুদ্রের নোনা পানি স্থলভাগের দিকে চলে আসে, যা মাটির উর্বরতা নষ্ট করে।
৪. তথ্যের অভাব: কোন দেশ কতটুকু পানি ছাড়ছে বা ধরে রাখছে, তার কোনো স্বচ্ছ ডিজিটাল তথ্য বিনিময় ব্যবস্থা নেই।
সমাধান কী হতে পারে?
নদী সমস্যার সমাধান কেবল কারিগরি নয়, এটি মূলত রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে।
-
বেসিন-ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা (Basin-wide Management): নদীকে টুকরো টুকরো করে না দেখে পুরো অববাহিকা ধরে সব দেশের সমন্বয়ে পরিকল্পনা করতে হবে। যেমন—ব্রহ্মপুত্র নিয়ে চীন, ভারত ও বাংলাদেশের একটি অভিন্ন কমিশন থাকা প্রয়োজন।
-
আন্তর্জাতিক আইনের বাস্তবায়ন: ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘের ‘Watercourses Convention’ অনুযায়ী আন্তঃসীমান্ত নদী ব্যবস্থাপনার নীতি মেনে চলতে দেশগুলোকে বাধ্য করা।
-
যৌথ তথ্য বিনিময়: হাইড্রো-মেটিওরোলজিক্যাল ডেটা বা পানির প্রবাহের তথ্য রিয়েল-টাইমে বিনিময় করতে হবে যাতে আকস্মিক বন্যা বা খরা মোকাবিলা করা যায়।
-
ন্যায্যতা ও ইক্যুইটি: ‘Harmful to none’ বা কারো ক্ষতি না করার নীতি অনুসরণ করে পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা।
-
আঞ্চলিক জোট গঠন: মেকং রিভার কমিশনের মতো সার্ক (SAARC) বা বিমসটেক (BIMSTEC) এর মাধ্যমে দক্ষিণ এশীয় নদীগুলোর জন্য একটি শক্তিশালী আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষ গঠন করা।
এশীয় অঞ্চলের নদীগুলো যেমন আশীর্বাদ, তেমনি বর্তমানে এগুলো তীব্র ভূ-রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সদিচ্ছা ও শুভ উদ্যোগের মাধ্যমে এসব সমস্যার কার্যকর সমাধান সম্ভব।

