গেরিলা যোদ্ধা রুহুল আমিন

সাক্ষাৎকার: ১৯৭১ সালের বীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা মো. রুহুল আমীন

 

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী: জাহাঙ্গীর আলম শোভন

প্রারম্ভিক কথা

শোভন: কেমন আছেন ? আজ আমরা আপনার বংশপরিচয়, ৬৯–৭১ সালের আন্দোলনে আপনার ভূমিকা এবং গেরিলা যুদ্ধের অভিজ্ঞতা জানতে চাই।

রুহুল আমীন: আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তোমাদের মতো তরুণরা যখন আমাদের কাছে এসব জানতে আসে, তখন মনে হয়—আমাদের সংগ্রামের ইতিহাস বেঁচে আছে।

বংশ পরিচিতি শৈশব

শোভন: প্রথমেই জানতে চাই, আপনার বংশপরিচয়?

রুহুল আমীন: আমাদের বংশকে বলা হয় উলাল মিয়ার বংশ। আমার বাবা হাজী ছাখাওয়াত উল্যা, দাদা রুস্তম মিয়া। আমাদের বড় বংশের মূল মানুষ ছিলেন ওয়াসেক মুন্সি। তিনি আরব দেশের বংশোদ্ভূত, ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে অবিভক্ত বাংলায় এসেছিলেন—৩৬০ জন অলি যে দলে এসেছিল, তাদেরই পথ অনুসরণকারী।
ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনেও তিনি সোচ্চার ছিলেন। তাঁর বংশধরই উলাল মিয়া, আর তাঁর নামেই আমাদের বাড়ির নামকরণ।

শোভন: আপনার বাবা এবং দের সম্পর্কে জানতে চাই।

রুহুল আমীন: বাবা বিদেশি জাহাজে চাকরি করতেন। আমার রা—মাওলানা করিম উল্যাহ ও হাফেজ মমিন উল্যাহ—দুজনই ছিলেন জ্ঞানী, ধার্মিক লোক। বাবা ১৯৪৯ সালে হজ্জ করে আসেন। এরপর ১৯৫১ সালে আমার জন্ম।

ছাত্রজীবন রাজনীতিতে প্রবেশ

শোভন: আপনি কীভাবে ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হলেন?

রুহুল আমীন: ১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময়। তখন দেশ উত্তাল। আমি তখন বসুরহাট এএইচসি স্কুলে পড়ি। পরে ঢাকা চলে যাই।
ঢাকার শ্যামপুর, হাতিরপুল—এই জায়গাগুলোতে ছাত্রদের সঙ্গে মিশতে মিশতেই আন্দোলনের ভিত বুঝে উঠি। ১১ দফা, ৬ দফা—সব আন্দোলনে রাস্তায় ছিলাম।

শোভন: সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যার সময় আপনি ঢাকায় ছিলেন?

রুহুল আমীন: হ্যাঁ! সেই দিনের উত্তেজনা আজও ভুলতে পারি না। দুপুরের পর পুরো ঢাকা মিছিলের ঢেউয়ে ভেসে গেছে। পুলিশ গুলি করছে, ১৪৪ ধারা, কারফিউ—তবুও মানুষ থামেনি।
এ সময়ই বুঝেছিলাম—বাংলার স্বাধীনতা অনিবার্য।

৭ই মার্চের পর এবং ট্রেনিং

শোভন: ৭ই মার্চের ভাষণ আপনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন?

রুহুল আমীন: অবশ্যই। রেসকোর্সে ১০ লক্ষেরও বেশি মানুষের ভিড়ে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ শুনেছিলাম—
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম!”
সেই দিনই সিদ্ধান্ত নিই—যুদ্ধে যাব।

শোভন: কোথায় ট্রেনিং নেন?

রুহুল আমীন: দুধমুখা এলাকায় প্রথমে স্থানীয়ভাবে। পরে ভারতে দুবার যাই। দ্বিতীয়বার ১০ জনকে নিয়ে শ্রীনগর ক্যাম্পে পূর্ণাঙ্গ গেরিলা ট্রেনিং করি।
সেখান থেকে ২টা রাইফেল, ১টি এসএমজি আর হাতে ৩৬ হ্যান্ড গ্রেনেড নিয়ে দেশে ফিরি পায়ে হেঁটে।

অপারেশন ফেনী মুক্ত হওয়া

শোভন: ফেনী মুক্ত করার ঘটনাটা শুনতে চাই।

রুহুল আমীন: আগস্ট–নভেম্বর পর্যন্ত আমরা প্রায় ১৮ জন মিলিত গেরিলা ইউনিট হিসেবে সোনাগাজী–ফেনী–কোম্পানীগঞ্জ এলাকায় বড় বড় অপারেশন করি।
৬ ডিসেম্বর ১৯৭১—ফেনী শত্রুমুক্ত হয়।
সারা দেশ স্বাধীন হওয়ার ১০ দিন আগেই আমরা আমাদের এলাকা মুক্ত করি—এটা আজও আমাদের গর্ব।

যুদ্ধপরবর্তী সংগ্রাম

শোভন: যুদ্ধের পর?

রুহুল আমীন: ছাত্রলীগ বিভক্ত হলো—আমি জাসদ ছাত্রলীগে যুক্ত হই। ফেনী থানার প্রচার সম্পাদক, পরে জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলাম।

কিন্তু রাজনীতি সহজ ছিল না—
১৯৭৪ সালে একবার, ১৯৭৫ সালে আবার আমাকে আটক করা হয়। একাধিক মামলা, ডিটেনশন… মোট ৩ বছর ৭ মাস জেল খাটি।
১৯৭৮ এর পর আর রাজনীতি করি না।

স্বাধীনতার চেতনাকে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ

শোভন: আপনি যে প্রতি বছর ফেনীতে পদযাত্রা আয়োজন করেন—এটা কীভাবে শুরু হলো?

রুহুল আমীন: মুক্তিযুদ্ধের বেদনা, সংগ্রাম—এসব তরুণদের জানাতে চাইতাম।
তাই ইয়াকুবপুরের তরুণ সংঘকে সঙ্গে নিয়ে আমরা টেকনাফ–তেতুলিয়া পদযাত্রা করি, পরে প্রতি ৬ ডিসেম্বর ফেনীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৪০–৫০ কিলোমিটার পদযাত্রা আয়োজন করি।
রাতে তরুণদের সঙ্গে বসে যুদ্ধের গল্প বলি।

উপসংহার

শোভন: , আপনার জীবন—সংগ্রাম, দেশপ্রেম, ত্যাগ—সবই এক মহাকাব্য। আমরা আজ যা জানলাম, তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মূল্যবান ইতিহাস।

রুহুল আমীন: আল্লাহর কাছে দোয়া করি—তোমরা যেন সত্য ইতিহাস তুলে ধরো। স্বাধীনতা বিনা দামে আসে নাই। তরুণেরা যদি এই চেতনা ধারণ করে, তাহলেই আমাদের ত্যাগ সার্থক হবে।

 

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply