ইকবাল বাহার

ইকবাল বাহার এর সাক্ষাৎকার: অল্পকিছু গল্প ছিল

বিশেষ সাক্ষাৎকার: ইকবাল বাহার জাহিদ

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: জাহাঙ্গীর আলম শোভন

বাংলাদেশের উদ্যোক্তা আন্দোলনে সবচেয়ে প্রতিধ্বনিত নামগুলোর একটি—ইকবাল বাহার জাহিদ।
এক গ্রামীণ ছেলেকে কীভাবে দেশের লক্ষ লক্ষ তরুণের অনুপ্রেরণায় পরিণত করেছে জীবন—তা জানতে বসেছিলাম তার সঙ্গে।

জাহাঙ্গীর আলম শোভন: আপনার শৈশবের গল্পটা জানতে চাই। কোথায় কাটিয়েছেন, সেই দিনগুলো কেমন ছিল?

ইকবাল বাহার জাহিদ:
আমার জন্ম ফেনীর ফুলগাজি উপজেলার এক যৌথ পরিবারে—একেবারে গ্রাম্য পরিবেশ। এসএসসি পর্যন্ত গ্রামের স্কুলেই পড়েছি। আমাদের গ্রামে তখন বিদ্যুৎ ছিল না। হারিকেনের আলোই ছিল রাতের পড়ার সঙ্গী। লজিং মাস্টারের বাড়িতে বসে হারিকেনের চিমনিতে মাথা লাগিয়ে কপাল গরম করে স্যারের কাছে অভিনয় করতাম—“স্যার, জ্বর এসেছে, ছুটি দেন…”—এখন মনে হলে হাসি পায়।
তবে যৌথ পরিবার আমাকে শুধু শৃঙ্খলা নয়—শেয়ারিং, কেয়ারিং, সহানুভূতি, আর পড়ে গিয়ে আবার উঠে দাঁড়ানোর শক্তি শিখিয়েছে।
আমার শৈশব ছিল সাদামাটা, কিন্তু সেই সাদামাটাতেই আজকের আমাকে তৈরি করেছে। রাতে বাইরে থাকার কোন সুযোগ ছিল না; নিয়মের ভেতরেই বড় হয়েছি। সত্যি বলতে—ফাঁকিবাজি ছিল, কিন্তু সীমাহীন অবাধ্যতা ছিল না।

জাহাঙ্গীর আলম শোভন: ঢাকায় কলেজ জীবন শুরু করার পর কী পরিবর্তন এলো?

ইকবাল বাহার জাহিদ:
ঢাকায় আসা ছিল আমার জীবনের এক বড় ধাক্কা। গ্রামের ছেলেটা হঠাৎ করে অপরিচিত স্বাধীনতা পেয়ে দিশেহারা হয়ে গেল। এসএসসিতে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েও ঢাকার কোনো ভালো কলেজে ভর্তি হতে পারলাম না—শেষ পর্যন্ত তিতুমির কলেজে ভর্তি হলাম বিজ্ঞান বিভাগে, বাবার ইচ্ছে ছিল ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে।

কিন্তু ঢাকায় এসে আমি যেন অন্য মানুষ—পড়াশোনা আমায় টানত না। টানত নাটক, গান, অভিনয়, উপস্থাপনা।
ফল—এইচএসসিতে ফেল।

যখন ফেল করলাম, মনে হলো পৃথিবীর সব আলো নিভে গেছে। পরিবার-আত্মীয়রা বলতে লাগল—“এই ছেলে শেষ, কিছুই হবে না।” তখন মানসিকভাবে এতটাই ভেঙে পড়েছিলাম যে সত্যি সত্যিই পালিয়ে যাওয়ার কথা ভেবেছি।
ঠিক তখনই আমার বাবা আমাকে বাঁচালেন—
“তোমার উপর আমার আস্থা আছে, আবার শুরু করো।”
এই কথাটাই আমাকে ফিরিয়ে দিল জীবনে।

তারপর কোনমতে সেকেন্ড ডিভিশনে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করি। আবারও হাসাহাসি—“এ তো মাষ্টারি ছাড়া কিছুই করতে পারবে না।” আজ ভাগ্যের irony হলো, সেই আমিই আজ লাখো তরুণকে শেখাই!

জাহাঙ্গীর আলম শোভন: এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হতে পারা—তা কি আপনাকে আরও নিরুৎসাহিত করেছিল?

ইকবাল বাহার জাহিদ:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর—সব জায়গায় ভর্তি পরীক্ষায় ব্যর্থতা। এমনকি জগন্নাথ কলেজেও না। চারদিক থেকে ব্যর্থ বলার সুর।
তখনই আমি বুঝলাম—আমার পথ অন্যরকম।

আমি কাউকে না বলে বিজ্ঞান থেকে সরে গিয়ে তিতুমির কলেজে বিকমে ভর্তি হলাম—কমার্সে ইউ-টার্ন নিলাম। আবার হাসাহাসি—“অনার্স পড়ার যোগ্যতা নেই!”

কিন্তু এবার আমি চুপ করিনি—প্রতিটি সেকেন্ড কাজে লাগাতে শুরু করলাম। পড়াশোনা, টিউশন, পার্টটাইম কাজ—সব একসাথে চালিয়ে গেলাম।
বিকম শেষ করে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সিতে ভর্তি হলাম—এইখানেই আমার ঘুরে দাঁড়ানোর শুরু। তখন আমার বন্ধুরা অনার্স বা ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং তৃতীয় বর্ষে, কিন্তু আমি তখন থেকেই রোজগার করছি।

জাহাঙ্গীর আলম শোভন: আপনার প্রেম, বিয়ে—এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে ক্যারিয়ার কীভাবে এগোলো?

ইকবাল বাহার জাহিদ:
এই বছরগুলোতে আমি প্রেমে পড়লাম এক অসাধারণ সুন্দর মেয়ের। তাকে বিয়ে করতে চাই—বাবাকে বললাম। বাবা বললেন—
“সিএ ইন্টার পাশ করো, তারপর দেখবো।”

সাধারণত যেখানে চার-পাঁচবার পরীক্ষা দিতে হয়, আমি বিয়ের তাড়নায় একবারেই পাশ করলাম। তিন বছর প্রেম করেছি, কখনো ডেট করিনি—ক্যারিয়ার তখন আমার কাছে প্রেমের থেকেও বড় ড্রাইভ ছিল।

তারপর মাস্টার্স করলাম, সিএ পড়লাম, এমবিএ করলাম।
এভাবেই ধীরে ধীরে নিজেকে তৈরি করেছি।

জাহাঙ্গীর আলম শোভন: কর্পোরেট ক্যারিয়ার কেমন ছিল? আর উদ্যোক্তা হওয়ার তাগিদটা কোথা থেকে এলো?

ইকবাল বাহার জাহিদ:
গ্রামীণ সাইবারনেট আমার প্রথম চাকরি। অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার হিসেবে প্রযুক্তির জগতে ঢোকার সুযোগ পেলাম।
কিন্তু সমস্যা হলো—৯–৫ টার চাকরি আমাকে সুখ দিত না। মনে হতো আমি যা করতে পারি তার খুব অল্পই চাকরিতে প্রয়োগ করতে পারছি।

মাথায় তখন একটাই স্বপ্ন—নিজের কোম্পানি। বন্ধুদের নিয়ে চেষ্টা করেছিলাম, কেউ চাকরি ছাড়ল না। হতাশ হলাম, কিন্তু থামিনি।

তারপর গ্রামীণ শক্তিতে গেলাম অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে।
ওখানে গিয়ে অপটিম্যাক্সের বীজ বপন করি।

শেষ পর্যন্ত চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি উদ্যোক্তায় ঝাঁপ দিলাম।
অপটিম্যাক্সের ১৮ মাসেই ব্যবসা বন্ধ হওয়ার উপক্রম—একই সময়ে আমার বাবা মারা যান—তখন আমি ভীষণ ভেঙে পড়েছিলাম।
কিন্তু সেই অন্ধকার থেকেই আমি আবার উঠে দাঁড়ালাম। আজ অপটিম্যাক্স বাংলাদেশের অন্যতম সফল ICT প্রতিষ্ঠান—২২ বছর ধরে চলছে।

সিঙ্গার বাংলাদেশে জেনারেল ম্যানেজার পদের অভিজ্ঞতা আমাকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। দ্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছি উদ্যোক্তা বিষয়ে। প্রতিদিন ১২–১৪ ঘণ্টা কাজ করতাম—এখনও করি।

জাহাঙ্গীর আলম শোভন: ‘নিজের বলার মতো একটা গল্প’—আপনার জীবনের সবচেয়ে আলোচিত উদ্যোগ। এটি শুরু হলো কীভাবে?

ইকবাল বাহার জাহিদ:
এক সময় উপলব্ধি করলাম—আমার আসল কাজ শুধু নিজের জন্য কিছু করা নয়; অন্যদের গল্প তৈরি করা।
বাংলাদেশে তখন ৫০ মিলিয়ন বেকার।
আমি ভাবলাম—যদি এই তরুণদের সাক্ষরতা, স্কিল, আত্মবিশ্বাস, উদ্যোক্তা মানসিকতা—সব একসঙ্গে শেখানো যায়?

এই ভাবনা থেকেই শুরু “নিজের বলার মতো একটা গল্প”।

গত ৭ বছর ১১ মাস ধরে প্রতিদিন ৪–৫ ঘণ্টা সময় দিচ্ছি।
২৯ লাখেরও বেশি তরুণকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি।
এটাই জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।

আমি চাই বাংলাদেশের প্রতিটি তরুণ নিজের জীবনে একটি গল্প তৈরি করুক, যা সে গর্ব করে বলতে পারে।

জাহাঙ্গীর আলম শোভন: আপনার স্ত্রী চামেলি—উনার ভূমিকা কতটা প্রভাব ফেলেছে আপনার জীবনে?

ইকবাল বাহার জাহিদ:
এসএসসি পাশের পরপরই চামেলি আমার জীবনে আসে।
তারপর তার এসএসসি থেকে শুরু করে এমবিএ—সবকিছুতেই আমি ছিলাম পাশে, আর সে ছিল আমার পাশে।
সে আজ একটি কোম্পানির সিইও, এটিএন বাংলার নিউজ প্রেজেন্টার।

সত্যি বলতে—চামেলি না থাকলে আমার জীবনে অনেক কিছুই হতো না। আমার প্রতিটি যুদ্ধে সে ছিল আমার নির্ভরতার জায়গা।

জাহাঙ্গীর আলম শোভন: পারিবারিক দিক থেকে কোন বিষয়গুলো আপনাকে শক্তি দিয়েছে?

ইকবাল বাহার জাহিদ:
আমার বাবা—উনার দোয়া আর শিক্ষা আমার জীবনের সব অর্জনের চাবিকাঠি।
অপটিম্যাক্সের শুরুতে যে অসম্ভব কঠিন সময় ছিল, ঠিক তখনই বাবা মারা যান—আমার হাতের ওপর।
তারপর মা-ই আমার সব।
আমি ভাগ্যবান—মায়ের সেবা করার সুযোগ পাচ্ছি।

জাহাঙ্গীর আলম শোভন: আপনার জীবনের সাফল্যের সংজ্ঞা কী?

ইকবাল বাহার জাহিদ:
আমার কাছে সাফল্য মানে বাড়ি-গাড়ি-টাকা নয়।
সাফল্য মানে—সুশিক্ষা, সুস্বাস্থ্য, সুসম্পর্ক, ভালো-মানের মানুষ হওয়া।
আর আমার সহকর্মীদের ২০০টি পরিবারের হাসিমুখ দেখতে পারাটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় পুরস্কার।

জীবনের সব পরীক্ষায় হয়তো দ্বিতীয় শ্রেণী পেয়েছি—
কিন্তু ক্যারিয়ার, পরিবার, মানুষের ভালোবাসায় আমি প্রথম শ্রেণী পেয়েছি—এটাই আমার গর্ব।

জাহাঙ্গীর আলম শোভন: শেষ প্রশ্ন—জীবনের শেষ পর্যন্ত আপনি কী নিয়ে কাজ করতে চান?

ইকবাল বাহার জাহিদ:
আমি শেষ দিন পর্যন্ত তরুণদের জন্য কাজ করতে চাই।
তাদের স্বপ্ন দেখতে শেখাতে চাই, নিজের গল্প তৈরি করতে সাহায্য করতে চাই।
“নিজের বলার মতো একটা গল্প”—এটাই আমার জীবনের উদ্দেশ্য, এটাই আমার আনন্দ, আমার ইবাদত, আমার শান্তি।

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply