নলদিয়া মেলার স্মৃতি ১
– জাহাঙ্গীর আলম শোভন
যখন মেলা কি সেটা বুঝতে শিখেছি তখন থেকে নলদিয়া মেলার স্মৃতি মনে আছে। তারপর বাবা কাকাদের সাথে মেলায় যাওয়ার আনন্দ সেটা আসলে আজ কোনো অনুভূতির সাথে তুলনায় চলে না ভাষায় প্রকাশও করা যায় না। তরুন বয়সে মেলায় দোকানদারী করার স্মৃতিও আছে। এবং আমাদের শৈশব থেকে মেলাটার ভাঙন শুরু হয়েছে। চোখের সামনে দেখেছি কিভাবে একটি বিখ্যাত বিশাল ও সুন্দর গ্রামীণ মেলা কিভাবে ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।
মেলা থেকে আমাদের বাড়ী কমপক্ষে ২ কিলোমিটার বা তারচেয়ে দূরে। মেলার সে ১৫ দিন কিংবা ২১ দিন সব সময় মেলার মাইকের শব্দ শোনা যেত। মেলায় যদি ১০টি হোটেল বা রেস্টুরেন্ট বসতো সাথে যদি ১০টি বিনোদন শো এসব ব্যবসার সাথে আরো বেশকিছু দোকানে বড় বড় মাইক লাগানো থাকতো তাতে হয়তো গান বাজতো অথবা মুখে মুখে বিজ্ঞাপন বাজানো হতো। মানে মুখে নানারকম খোশগল্প আর রসালো কথা বলে খদ্দের ডাকতো। মেলায় যখন যেতাম না তখন এটা শুধু শব্দই শুনতে পেতাম।
মেলা শুরু হলে মাইকের শব্দের মাধ্যমে আমরা জানতাম। বেশীরভাগ মানুষ প্রথমদিকে না গিয়ে মেলার শেষের দিকে যেত। ৪/৫ দিন শুরু হতো আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে দূর দূরান্ত থেকে মানুষ পাঁয়ে হেঁটে সাইকেলে মেলায় যেত, কেউ একা, দেউ দলবল নিয়ে, কেউ পরিবার পরিজন নিয়ে কেউবা আবার শুধু শিশুদের নিয়ে যেত। আমরা শুধু দেখতাম। আমার দাদু (দাদী) তখন আমার চাচাদের বলতে শুরু করতেন আমাদের যেন একদিন মেলায় নিয়ে যায়। তারপর ২/৪ দিন অপেক্ষা করার পর সেজকাকা এবং ছোট কাকা আম্মাকে বলতো আমাদের ৩ ভাই বোনকে যেন মেলার জন্য রেডি করে দেয়।
তারপর আম্মা গোসল করিয়ে ভাল জামা পরিয়ে মাথায় তেল আর মুখে ক্রিম মাখিয়ে কপালের কোনায় একটা কালো টিপ দিয়ে রেডি করে দিতেন। দাদু আর আম্মা বার বার বলে দিতেন আমাদের হাত যেন ছেড়ে দেয়া না হয়। কারণ মেলায় এত মানুষ আর এত ভীড় অনেক শিশুই হারিয়ে যেত। আমি আমার ছোটভাই আমরা পিঠাপিঠা ছিলাম। আমার বোন আমাদের চেয়ে ছোট হলেও বেশ আদুরে থাকা|য় আমরা ৫/৬ বছরে মেলায় যাওয়ার সুযোগ পেলেও সে ৩/৪ বছর বয়সে মেলায় যাওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়।
মেলায় আমাদের কয়েকটি পর্ব প্রথম পর্ব হলে এক চক্কর ঘুরে দেখা মাঝার জিয়ারত করা, দ্বিতীয় পর্ব হলো খেলনা কেনা, তৃতীয় পর্ব হলো কোনো খেলা দেখা যেমন পতুল নাচ, সার্কাস বা মোটর শো। তারমধ্যে আমরা সবচেয়ে আমোদিত হতাম সার্কাসে হাতি ঘোড়া বাঘ ভাল্লুকের খেলা দেখে। সারাদিনের জন্য মেলায় যেতাম তাই দুপুরে রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়া আমাদের আরেকটি কাজ। শেষে আমাদেরকে রেস্টুরেন্টে বসিয়ে কাকারা যেতেন বাড়ির জন্য কিছু কিনতে। যেমন মোয়া, ( মোল্লা) দোয়াজা, বরই, জিলাপী, মন্ডা ও মিঠাই এসব। মেলা থেকে বাড়ির লোকদের জন্য এসব না আনলে মেলা কিন্তু অসম্পূর্ণ থেকে যেত।
এছাড়া দরকারী জিনিসপত্র কেনা হতো যেমন পিড়ি, কুলা, ঝুড়ি এসব। আর প্রায় সচ্চল সব পরিবারই মেলা থেকে কোনো কোনো ফার্নিচার কিনতো। যেমন মিটসেপ, আলমিরা, খাট, চেয়ার, টেবিল, আলনা ইত্যাদি। এটা একটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল এবং অনেকে সারাবছর টাকা জমাতেন মেলার সময় কিছু একটা কিনবে বলে।
স্কুলে ভর্তি হওয়ার মেলা আরো ১ কিলোমিটার এগিয়ে গেল। আর মেলার সময় আশপাশের স্কুলগুলোতে ঠিকমতো ক্লাস হতো না। আশপাশের শিশুকিশোররা প্রায় প্রতিদিন মেলায় যেত। আমরা মনে মনে আফসোস করতাম আহারে আমাদের বাড়ি মেলা লাগোয়া হলে কতো না খুশি হতাম। তবুও আমরা দুপুরে স্কুল ছুটির পর প্রায় দিন মেলায় চেল যেতাম। না খেয়ে বিকেল পর্যন্ত ঘুরে বাড়ি ফিরতাম। হয়তো কোনো ২/৪ টাকা থাকলে কিছু খেতাম বা কিনতাম।
আমার ছোট ভাই বা আমাদের ভাইবোনদের মেঝো ওর যখন বয়স বছর দশেক হলো ও ভয়ানক মেলা আসক্ত হয়ে পড়লো। ১৫/২০ দিন প্রতিদিন সকালে মেলায় চলে যেত আর বিকেলে আসতো। শুধু দেখতো মেলার রঙীন দোকান, খেলনার বাহার, খেলা ধুলা আর নানা রকম মানুষ। কখনো কখনো সার্কাসের টিকেট পাওয়া যেতনা আর তখন আমরা ছোটরা প্যান্ডেলের পেছনে গিয়ে বাধা হাতি ঘোড়া বিনা টিকেটে দেখে চলে আসতাম। আর আমাদের মতো ছোট বন্ধুদের সাথে এমনভাবে গল্প করতাম যেন কিছু একটা হাসিল করে এসেছি।
মেলায় সারাদিন ঘোরার কিছু সুবিধা আছে। পরিচিত বা পাড়া প্রতিবেশীদের অনেকের দোকান থাকে। তখন তারা দুপুর হয়ে বাচ্চাদের ডেকে খাবার দিতো বিশেষ খাবারের দোকান যাদের থাকতো। মিষ্টি, পিঠা, আইসক্রিম, টি স্টল এসব। আবার কখনো বিনাটিকেটে বিভিন্ন শো দেখা যেত। বিশেষ করে যখন টিকেট কাউন্টারে বা প্রবেশ পথে পরিচিত কেউ থাকতো অনুরোধ করলে ভেতরে যেতে দিত। আর ভেতরে একবার গেলেতো চিন্তা নেই। পুরো শো দেখে বের হওয়া যেত। তাই যাদের বাড়ি মেলা থেকে দূরে নয় তাদের এই সুবিধা ছিল। আর যাদের বাড়ি একবারে মেলা লাগোয়া তারা কখনো এসব শো দেখতে টাকা খরচ করেছে বলে শুনিনি।
আমরা যখন ৮/১০ কিলোমিটার দূরে আমাদের কোনো আত্মীয় বাড়িতে যেতাম। তখন আমাদের বয়সীরা আমাদের কাছে মেলা সম্পর্কে জানতে চাইতো। কারণ অতদূরে সব পরিবার তাদের শিশুদের মেলায় আনতো না কিছু কিছু পরিবার আনতো বাকীরা শিশুদের জন্য খেলনা কিনে নিয়ে যেত। আর যাদের শিশুরা আসতো তারা তাদের কাছ থেকে যেসব গল্প শুনতো সেগুলো আমাদের কাছ থেকে যাচাই করার চেষ্টা করতো। তাদের চাহনী দেখে মনে হতো তারা মনে মনে ভাবছে আমরা কতটা ভাগ্যবান আমাদের বাড়ির পাশে মেলা বসে।
আমরা আসলে ছোটবেলায় জানতাম না যে, দেশে আরো এরকম অনেক মেলা থাকতে পারে। আমাদের কাছে মেলা মানে নলদিয়া মেলা একটাই। আমাদের মেঝো বার বার বলতো ইশ আমাদের বাড়ী যদি মেলা লাগোয়া হতো তাহলে কত না মজা হতো। তার শিশুমনে মেলা অনেক রং ধরিয়েছিল। সারাদিন মেলায় গিয়ে সে যা দেখতো তা তার মনে কি ভাবনা জাগাতো তা কখনো জানা হয়নি।
চলবে-
মেলা নিয়ে আমার এবং আমাদের অনেক স্মৃতি আছে। পরে লেখার অভিপ্রায় রইলো

